চাকরির মেয়াদ শেষ হলো।দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা গেলেন অবসরে। আর তখনই বন্ধ হয়ে গেল তার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রায় ৮০০ কোটি টাকার গবেষণা প্রকল্প। দক্ষিণাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ লবণপানির অনুপ্রবেশ বিষয়ক এ গবেষণার সুফল কৃষকের ভাগ্যে জুটল না। যেন পুরো টাকাটাই গেল লবণপানিতে। তবে গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও প্রকল্পের কর্মচারীরা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন নিয়মিত। গবেষণার জন্য সরকারি তহবিলের বিপুল টাকা ব্যয়ে কেনা মূল্যবান যন্ত্রপাতিও ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন তারা। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে। করপোরেশনে এভাবে অতীতেও অনেক গবেষণা প্রকল্পের অপমৃত্যু ঘটেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাইনর ইরিগেশন ইনফরমেশন সার্ভিস ইউনিটের অধীনে ‘দি প্রোগ্রাম অব ফোরকাস্টিং স্যালাইন ওয়াটার ইরিগেশন, ইরিগেশন ওয়াটার কোয়ালিটি অ্যান্ড ওয়াটার লগিং ইন সাউদার্ন
এরিয়া’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয়। গবেষণা প্রকল্পের শুরুতে ৩৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরের তিন বছরে এ গবেষণা খাতে আরও সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সবমিলে এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮১০ কোটি টাকা। বিএডিসির ৩৫টি কর্মসূচির মাধ্যমে বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়। সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে ভূগর্ভে ৮ হাজার কিলোমিটার সেচনালা নির্মাণে। ব্যবহার না হওয়ায় এসব সেচনালাও কাদামাটিতে ভরাট হয়ে গেছে।
বিএডিসির এ গবেষণা প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় সাড়ে তিন হাজার পর্যবেক্ষণ কূপ, ২০০ স্পটে উচ্চ প্রযুক্তির ডাটা সার্ভার স্টেশন, ভূগর্ভে আট হাজার কিলোমিটার সেচনালা খনন এবং প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার গবেষণা যন্ত্রপাতি কেনা হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে ভূগর্ভস্থ পানির অনুপ্রবেশ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ শুরু করে বিএডিসি। এসব তথ্য সংগ্রহে সমুদ্র উপকূলে ১৬৮টি লবণ পর্যবেক্ষণ নলকূপ বসানো হয়। এসব নলকূপে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
মাটির নিচের লবণাক্ত পানির অস্তিত্ব নিরূপণ ও সার্ভে চালানোর জন্য যন্ত্রপাতি কেনা হয়। গবেষণায় ভূ-উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও গবেষণায় জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস), ভৌগোলিক জরিপ ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য প্রযুক্তি ও মডেল ব্যবহার করা হয়। সর্বশেষ এতে ২০১৪ সালের এপ্রিল এবং মে মাসের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর পর ২০১৪ সালের জুনে বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান এবং গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. ইফতেখারুল আলম অবসরে যান। বর্তমানে তিনি বিশ্বব্যাংকের এমডিএসপি প্রকল্পে সিনিয়র পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
গত বছরের সেচ মৌসুম শুরুর আগে অক্টোবর ও নভেম্বরে তথ্য সংগ্রহের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এর আগে এপ্রিল-মে মাসের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের অনীহায় এ গবেষণা প্রকল্পটি ভেস্তে যেতে বসেছে। অথচ এ ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বেতন-ভাতা ঠিকই নিচ্ছেন।
প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ২০০ ডাটা পাওয়ার ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৭০টির অস্তিত্ব আছে। বাকিগুলো উধাও হয়ে গেছে। সাড়ে তিন হাজার পর্যক্ষেণ কূপও বেহাত হয়ে গেছে। অযত্নে-অবহেলায় আট হাজার কিলোমিটার ভূগর্ভ সেচনালার অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ড. ইফতেখারুল আলম বলেন, প্রকল্পটির আওতায় উপকূলীয় এলাকায় ২০০ অটো ওয়াটার টেবিল রেকর্ডার ও সাড়ে তিন হাজার পর্যবেক্ষণ কূপ স্থাপন করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর অবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জানার জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ তৈরি, ৮ হাজার কিলোমিটারের খালকাটা, ভূগর্ভস্থ সেচনালা তৈরি এবং রাবার ড্যাম নির্মাণও প্রকল্পের আওতায় ছিল। ভূগর্ভস্থ হয়ে দক্ষিণের সাগর থেকে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করে সমস্যার প্রকৃতি ও সম্ভাব্য সমাধান নির্ণয় করা ছিল এ গবেষণার মূল কাজ। প্রথম তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণা কার্যক্রম চলছে। পরবর্তী সময়ে তথ্য সংগ্রহ ও আপডেট না করায় গবেষণাটি মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এ গবেষণা প্রকল্প নেওয়া হয়। তিনি বলেন, গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বিএডিসি কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দিয়েছি। বিএডিসি চাইলে তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে এ কাজে সহায়তা করতে চান। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ এতে সাড়া দিচ্ছে না। বরং বিএডিসির কর্মকর্তারা এ প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভাগ ভাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা-পয়সা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রকৌশলী ইফতেখারুল আলম গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে খাবার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ থেকে ৩০ বছর আগে মাটির নিচ দিয়ে লোনা পানি আসত মাত্র ৬০ কিলোমিটার উত্তরে। এখন আসছে ১০০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার উত্তরে। তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ সংক্রান্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। পানির স্তর নেমে মূল ভূখ ে লোনা পানি প্রবেশ করলে কৃষি ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লবণপানির আগ্রাসনের প্রতিকার নিরূপণে গবেষণাটি চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন, বিপুল অর্থ ব্যয়ে যেসব অত্যাধুনিক গবেষণা যন্ত্রপাতি, মেশিন কেনা হয়েছে_ তা তো আর অন্য কোনো কাজে আসবে না। ফলে গবেষণা অব্যাহত না রাখলে বিপুল অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
বিএডিসির (ক্ষুদ্র সেচ) উপ-প্রধান প্রকৌশলী লুৎফর রহমান বলেন, ডাটা সংগ্রহের জন্য এ প্রকল্পের বরাদ্দ না থাকায় এক বছর ধরে কার্যক্রম বন্ধ আছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে আবার ডাটা সংগ্রহ করে গবেষণা করা হবে। এক বছরের তথ্য না পাওয়া গেলেও ‘মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এর আগের বছরের কাছাকাছিই ডাটা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে তারা ১০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেননি। গবেষণার জন্য কেনা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চুরি বা কেউ নেয়নি বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএডিসির চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, তিনি এ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। তবে এ প্রকল্পের প্রধান গবেষক ইফতেখারুল আলমের সঙ্গে এ নিয়ে তার আলাপ হয়েছে। তিনি এ গবেষণাকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
দি গ্লোবাল নিউজ ২৪ ডট কম/রিপন/ডেরি