মোঃ আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ (সিলেট) থেকে :: সিলেটের বিশ্বনাথে ঝপ ঝপ’ শব্দের তালে তালে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো বাওয়া উৎসব’ পালিত হয়েছে। রোববার উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি গ্রামের দক্ষিণের (বড়) বিলে এ পলো বাওয়া অনুষ্ঠিত হয়। বাঁশ আর বেতের সমন্বয়ে তৈরী করা পলো ও উড়াল-চিটকি-ঠেলা জাল দিয়ে শীত উপেক্ষা করে এক সাথে মাছ শিকার করাই গ্রামবাসীর প্রধান এক আনন্দের উৎসব। তাই আনন্দের ওই উৎসব পালন করতে প্রতি বছর পহেলা মাঘের অপেক্ষায় থাকেন গ্রামবাসী। পলো বাওয়াকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। এতে অংশগ্রহন করেন গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষ। গোয়াহরি গ্রামের ঐহিত্য অনুযায়ী প্রায় দু’শত বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাংলা বছরের প্রতি মাঘ মাসের ১ তারিখ এই পলো বাওয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
রোববার সকাল ৮টা থেকে সৌখিন মানুষ বিলের পারে এসে জমায়েত হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিলের পারে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হৈ হৈ করে একসাথে পলো-জাল হাতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন সবাই। ঝপ ঝপ শব্দের তালে তালে চলতে থাকে পলো পাওয়া। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী এ ‘পলো বাওয়া উৎসবে’ গোয়াহরি গ্রামের সব বয়সী পুরুয় অংশ নেন। গ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি ঘর থেকে একজন পুরুষ পলো নিয়ে উৎসবে অংশগ্রহন করেন। যাদের পরিবারে পুরুষ সদস্য বাড়িতে নেই, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে কোন আত্মীয় মাছ শিকারে অংশগ্রহন করেন। এবছর বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ থাকার পরও পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহন করা কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি। এমনকি শিশুরাও জাল দিয়ে বিলের তীরের কাছে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়েছে। আর তরুণ-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবাই বোয়াল, রুই, গজার, কালীবাউস, শোল, বাউশ, কার্পু, কাতলা, শিং, মাগুর, কৈ’সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করেন। একেকটি মাছ শিকারের সাথে সাথে চিৎকার করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন শিকারীরা। শিকারীদের ওই আনন্দের সাথে সাথে তাল মেলান বিলের তীরে অপেক্ষমান গ্রামের মুরব্বী, মহিলা ও শিশুরা। দূর থেকে আসা অনেকের আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিলের পাড়ে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কয়েক শতাধিক লোক পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহন করেন। বিল থেকে গত বছরের তুলনায় মাছ শিকার হয়েছে বেশী।
এই উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বাবা-চাচা, ভাই-দাদা, মামা-ফুফার সাথে আসা শিশুরা। নিজের আত্মীয়-স্বজনের কেউ মাছ শিকার করলে তাদের আনন্দ আর কে দেখে! বিলের তীরে শিশুরা অপেক্ষা করে কখন নিজের কেউ মাছ শিকার করে এনে তাদের হাতে দেবেন, আর তারা কখন নিজের শরীরের প্রায় অর্ধেক ওজনের মাছটি বহন করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। মাছ শিকারের পর চিৎকারের আওয়াজই এলাকাকে জানিয়ে দেয় কেমন পরিমাণ মাছ শিকার করেছেন শিকারীরা।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে গত কয়েকদিন ধরে উৎসবের আমেজ রিবাজ করছিল। এই উৎসব ১৫ মাঘ পর্যন্ত চলবে। গোয়াহরি গ্রামের পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এই পনের দিন বিলে মাছ ধরায় আটল (নিশেধাজ্ঞা) জারি করা হয়েছে। তবে গ্রামবাসীর ঐতিহ্য অনুযায়ী আগামী ১৫ মাঘ ২য় ধাপে পলো বাওয়া হবে। এই পনের দিনের ভিতরে প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার বিলে হাত দিয়ে মাছ ধরা হবে এবং কেউ চাইলে পেলান জান (হাতা জাল) দিয়ে মাছ ধরতে পারবেন।
গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী হাজী তৈমুছ আলী বলেন, পলো বাওয়া উৎসব আমাদের গ্রামের একটি ঐতিহ্য। আমাদের গ্রামবাসী পূর্বপুরুষের আমল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছেন। বয়সের কারণে এখন আর পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবে জীবনে ওই বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ শিকার করেছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য গোলাম হোসেন বলেন, ‘পলো বাওয়া’ উৎসব আমাদের পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা গ্রামবাসী একসাথে প্রতি বাংলা বছরের ১লা মাঘ বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসব পালন করে থাকি। এই উৎসবের আনন্দ অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে পাওয়া যাবে না।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী রহমত উল্লাহ আব্দুল্লা বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে প্রবাসে বসবাস করে আসছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্যস্ততার কারণে কখনও পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এবার তা পূরণ হয়েছে।
পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নেওয়া উপজেলার কালীগঞ্জের এম এ রব ও চৌধুরীগাঁও গ্রামের তাহিরান আলী বলেন, গ্রামে আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে অন্যান্য বছরের মতো এবারও বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহণ করে মাছ শিকার করেছি। অন্য গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার পরও গোয়াহরি গ্রামবাসী তাদের আনন্দের এই উৎসবে শরিক হওয়ার সুয়োগ দেওয়ায় আমরা আনন্দিত।
প্রবাসী মুজিবুর রহমান, ময়নুল হক, ওয়াহিদুর রহমান জানান, এই মাছ ধরায় অংশ নিতে পেরে তাদের খুব আনন্দ লাগছে। তারা পলো বাওয়ায় অংশগ্রহন করতে প্রবাস থেকে দেশে এসেছেন। পলো দিয়ে মাছ শিকার তাদের কাছে একটি মজার বিষয়।
এবারের পলো বাওয়া উৎসবে তজম্মুল আলী ২টি বোয়াল ও ১টি কার্পু, জাহাঙ্গীর আলম কয়েছে ২টি বোয়াল ও ১টি শোল, আব্দুল আহাদ ২টি বোয়াল, মিজানুল করিম ৩টি বোয়াল ও ১টি ঘাসকার্প, তোফায়েল আহমদ ২টি বাউশ, সিরাজুল ইসলাম ১টি বোয়াল, আতাউর রহমান ১টি শোল, লিমন মিয়া ২টি রুই, মাহফুজুর রহমান সুজন ১টি বোয়াল ও ২টি কাতলা মাছ শিকার করেছেন।